গলার মাঝখানে ফোলা: থাইরোগ্লোসাল সিস্ট কি উদ্বেগের কারণ?

প্রায়ই অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন, যাদের গলার সামনের দিকে মাঝ বরাবর বা একটু উপরের দিকে একটি ছোট ফোলা বা পিণ্ডের মতো দেখা যায়।। এই ধরনের ফোলা দেখলে স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মায়েরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। গলার এই ফোলাটির একটি অন্যতম সাধারণ কারণ হতে পারে থাইরোগ্লোসাল ডাক্ট সিস্ট (Thyroglossal Duct Cyst)

আজকে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে সাধারণ মানুষ থাইরোগ্লোসাল সিস্ট কী, কেন হয়, এবং এর সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন।

থাইরোগ্লোসাল সিস্ট আসলে কী?

থাইরোগ্লোসাল সিস্ট হলো একটি জন্মগত ত্রুটি, যেখানে গলার মাঝখানে একটি তরল ভর্তি থলি বা সিস্ট তৈরি হয়। এটি কোনো ক্যান্সার বা টিউমার নয়, বরং ভ্রূণ অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থির বিকাশের সময় তৈরি হওয়া একটি সমস্যা।

বিষয়টি সহজভাবে বোঝার জন্য আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। যখন একটি শিশু মায়ের গর্ভে থাকে, তখন তার থাইরয়েড গ্রন্থিটি জিহ্বার গোড়ার দিকে তৈরি হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে এসে গলার নির্দিষ্ট স্থানে (যেখানে এটি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় থাকে) স্থায়ী হয়। যে পথ দিয়ে থাইরয়েড গ্রন্থিটি নিচে নেমে আসে, তাকে থাইরোগ্লোসাল ডাক্ট (Thyroglossal Duct) বলা হয়। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, শিশু জন্মের আগেই এই নালীটি শুকিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই নালীর কিছু অংশ থেকে যায় এবং পরবর্তীতে এর মধ্যে তরল জমে একটি সিস্ট বা থলি তৈরি হয়। একেই থাইরোগ্লোসাল ডাক্ট সিস্ট বলা হয়।

Thyroglossal cyst

কাদের এই সমস্যা বেশি হয়?

যেহেতু এটি একটি জন্মগত সমস্যা, তাই এটি সাধারণত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে ২০ বছর বয়সের মধ্যেই এটি প্রকাশ পায়। তবে, মাঝেমধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও এটি প্রথমবার ধরা পড়তে পারে। নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই এটি সমানভাবে দেখা যায়।

থাইরোগ্লোসাল সিস্টের লক্ষণগুলো কী কী?

এর লক্ষণগুলো বেশ নির্দিষ্ট, যা দেখে একজন চিকিৎসক সহজেই রোগটি সন্দেহ করতে পারেন।

  • গলার মাঝখানে ফোলা: সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো গলার সামনের দিকে, ঠিক মাঝ বরাবর একটি ছোট, নরম এবং সাধারণত ব্যথাহীন ফোলা বা পিণ্ড।
  • ঢোক গেলার সময় বা জিহ্বা বের করলে নড়াচড়া করা: এটি থাইরোগ্লোসাল সিস্টের একটি বিশেষত্ব। রোগী ঢোক গিললে বা জিহ্বাটি মুখের বাইরে বের করলে এই ফোলাটি গলার উপরের দিকে উঠে আসে। এর কারণ হলো, যে নালী থেকে এই সিস্টটি তৈরি হয়, তা জিহ্বার গোড়ার সাথে সংযুক্ত থাকে।
  • সংক্রমণ (Infection): অনেক সময় এই সিস্টে ইনফেকশন হতে পারে। তখন ফোলাটি হঠাৎ করে বড় হয়ে যায়, লাল হয়ে যায়, ব্যথা করে এবং গরম অনুভূত হয়। ইনফেকশন গুরুতর হলে সিস্ট ফেটে গিয়ে পুঁজ বা তরল বের হয়ে আসতে পারে এবং ত্বকের উপর একটি ছিদ্র (Sinus Tract) তৈরি হতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট বা গিলতে অসুবিধা: সিস্টটি খুব বেশি বড় হয়ে গেলে শ্বাস নিতে বা খাবার গিলতে সামান্য অসুবিধা হতে পারে, যদিও এটি খুব বিরল।

কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়?

একজন অভিজ্ঞ ইএনটি বিশেষজ্ঞ সাধারণত রোগীর ইতিহাস শুনে এবং শারীরিক পরীক্ষা করেই থাইরোগ্লোসাল সিস্ট সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। ফোলাটির অবস্থান এবং ঢোক গেলার সাথে এর নড়াচড়া পরীক্ষা করা হয়। তবে রোগটি নিশ্চিত করার জন্য এবং অন্যান্য সম্ভাবনা বাদ দেওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

  1. আলট্রাসনোগ্রাম (Ultrasonography): এটি একটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং কার্যকর পরীক্ষা। এর মাধ্যমে সিস্টের আকার, এটি তরল ভর্তি কি না, এবং এর ভেতরের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই পরীক্ষার মাধ্যমে গলার স্বাভাবিক থাইরয়েড গ্রন্থিটি সঠিক জায়গায় আছে কি না, তা নিশ্চিত করা হয়।
  2. সিটি স্ক্যান (CT Scan) বা এমআরআই (MRI): যদি সিস্টের অবস্থান বা গঠন নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে, তবে সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করার প্রয়োজন হতে পারে।
  3. এফএনএসি (FNAC): এক্ষেত্রে একটি সূক্ষ্ম সুই দিয়ে সিস্ট থেকে কোষকলা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে ভেতরে কোনো অস্বাভাবিক কোষ আছে কি না, তা জানা যায়।

এর চিকিৎসা কী?

থাইরোগ্লোসাল সিস্টের একমাত্র কার্যকর এবং স্থায়ী চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার বা সার্জারি। অনেকে মনে করেন, শুধু সিস্টের পানি বের করে দিলেই হয়তো এটি ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু এটি ভুল ধারণা। কারণ সিস্টের উৎস যে নালীটি (Duct), তা অপসারণ না করলে সিস্টটি বারবার হতে থাকবে।

এই অস্ত্রোপচারটির একটি নির্দিষ্ট নাম রয়েছে—সিস্ট্রাঙ্ক অপারেশন (Sistrunk Procedure)। এই অপারেশনে যা করা হয়:

  • সিস্টটিকে সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করা হয়।
  • সিস্টের সাথে সংযুক্ত সম্পূর্ণ থাইরোগ্লোসাল নালীটিকে জিহ্বার গোড়া পর্যন্ত তুলে ফেলা হয়।
  • নালীটি গলার একটি ছোট হাড়ের (Hyoid Bone) মাঝখান দিয়ে যায়, তাই অপারেশনের সময় ওই হাড়ের কেন্দ্রীয় অংশটুকুও কেটে ফেলা হয়।

হাড়ের অংশটুকুসহ সম্পূর্ণ নালী অপসারণ করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ তা না হলে রোগটি পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০% থেকে যায়। কিন্তু সিস্ট্রাঙ্ক পদ্ধতিতে সঠিকভাবে অপারেশন করা হলে, রোগটি আবার হওয়ার সম্ভাবনা ৫% এরও নিচে নেমে আসে।

যদি সিস্টে ইনফেকশন থাকে? যদি সিস্টে ইনফেকশন বা প্রদাহ থাকে, তবে প্রথমে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ঔষধ দিয়ে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ইনফেকশন সেরে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর অপারেশনের দিন নির্ধারণ করা হয়।

এটি কি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে?

এটি একটি সাধারণ উদ্বেগ। আনন্দের বিষয় হলো, থাইরোগ্লোসাল সিস্ট থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত কম (প্রায় ১%)। তবে যেহেতু সামান্য হলেও একটি ঝুঁকি থাকে, তাই অপারেশনের পর অপসারিত সিস্ট এবং নালীটিকে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়।

শেষ কথা

গলার মাঝখানে যেকোনো ফোলা, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, অবশ্যই গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। থাইরোগ্লোসাল ডাক্ট সিস্ট একটি সাধারণ সমস্যা, তবে এর সঠিক রোগ নির্ণয় এবং সময়মতো চিকিৎসা প্রয়োজন। এটি ফেলে রাখলে বারবার ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা পরবর্তীকালে অপারেশনের জন্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই, আপনার বা আপনার সন্তানের গলায় এ ধরনের কোনো ফোলা দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top