আমাদের কাছে প্রায়ই এমন রোগী আসেন যারা অভিযোগ করেন যে তাদের নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। প্রথম দেখায় এটিকে সাধারণ সর্দি বা অ্যালার্জির সমস্যা মনে হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি সত্যিই তেমন কিছু নয়, তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে নাক দিয়ে যে তরল ঝরছে, তা সাধারণ সর্দি নয়, বরং মস্তিষ্কের চারপাশের তরল (Cerebrospinal Fluid বা CSF) হতে পারে। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সিএসএফ রাইনোরিয়া (CSF Rhinorrhea) বলা হয়, এবং এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত অবস্থা যার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
আজকের পোষ্টে আমি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সাধারণ মানুষ কীভাবে এই গুরুতর অবস্থাটিকে সাধারণ সর্দি থেকে আলাদা করতে পারবেন, এর কারণ কী, কী কী লক্ষণ দেখা যায় এবং এর সঠিক চিকিৎসা কী, তা সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
সিএসএফ (CSF) কী এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সিএসএফ বা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড হলো এক ধরণের পরিষ্কার, বর্ণহীন তরল যা আমাদের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডকে ঘিরে থাকে। এটি মস্তিষ্কের কোষে পুষ্টি যোগায়, বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মস্তিষ্ককে যেকোনো ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করে একটি সুরক্ষা কুশন হিসেবে কাজ করে। এই তরলটি মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট স্থান (subarachnoid space) এবং সিস্টেমের মধ্যে থাকে।
সিএসএফ রাইনোরিয়া (CSF Rhinorrhea) কী?
যখন মাথার খুলির হাড়ে কোনো ফাটল বা ছিদ্র তৈরি হয়, তখন মস্তিষ্কের চারপাশের এই সিএসএফ নাকের পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এই অবস্থাকেই সিএসএফ রাইনোরিয়া বলা হয়। যেহেতু মস্তিষ্কের আস্তরণ (dura) ফেটে যাওয়ায় এই তরল বেরিয়ে আসে, তাই মস্তিষ্কে সরাসরি সংক্রমণ (যেমন মেনিনজাইটিস) হওয়ার গুরুতর ঝুঁকি থাকে।

সিএসএফ রাইনোরিয়ার কারণসমূহ:
সিএসএফ রাইনোরিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে। প্রধান কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
- আঘাত (Trauma): এটি সিএসএফ রাইনোরিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ।
- মাথার আঘাত: সড়ক দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া বা খেলাধুলার সময় মাথায় গুরুতর আঘাত লাগলে মাথার খুলির হাড়ে ফাটল সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে সিএসএফ লিক করে।
- অস্ত্রোপচারজনিত আঘাত (Iatrogenic Trauma): নাক বা সাইনাসের কোনো অস্ত্রোপচারের (যেমন এন্ডোস্কোপিক সাইনাস সার্জারি) সময় ভুলবশত মাথার খুলির নিচের অংশে থাকা হাড়ে ছিদ্র তৈরি হলে সিএসএফ লিক হতে পারে।
- স্বতঃস্ফূর্ত (Spontaneous) বা ইডিওপ্যাথিক (Idiopathic): কিছু ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট আঘাত ছাড়াই সিএসএফ লিক করতে পারে। এটি সাধারণত মাথার খুলির দুর্বল অংশের কারণে হয়, যা মস্তিষ্কের চাপ বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। স্থূলতা (Obesity) এই ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত লিকের একটি পরিচিত ঝুঁকির কারণ।
- টিউমার বা সংক্রমণ: খুব বিরল ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের টিউমার বা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের কারণে হাড়ের ক্ষয় হলে সিএসএফ লিক করতে পারে।
- জন্মগত ত্রুটি (Congenital Defects): কিছু শিশু জন্মগতভাবে মাথার খুলির হাড়ে ছোট ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে সিএসএফ লিকের কারণ হতে পারে।
সিএসএফ রাইনোরিয়ার লক্ষণসমূহ: কখন সতর্ক হবেন?
নাক দিয়ে পানি পড়া একটি সাধারণ ব্যাপার, তাই সিএসএফ রাইনোরিয়াকে সাধারণ সর্দি থেকে আলাদা করা জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ দেওয়া হলো যা দেখে আপনি সতর্ক হতে পারেন:
- স্বচ্ছ, পাতলা, পানির মতো তরল: নাক দিয়ে যে তরল ঝরছে তা খুবই পাতলা, স্বচ্ছ এবং পানির মতো। এটি সর্দির মতো ঘন বা আঠালো হয় না।
- এক নাক দিয়ে পড়া: সাধারণত একটি নির্দিষ্ট নাকের ছিদ্র দিয়ে তরল ঝরতে থাকে।
- মাথা নিচু করলে বা হাঁচি-কাশি দিলে বেড়ে যাওয়া: মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে নিচু করলে বা হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় তরল নিঃসরণ বেড়ে যায়।
- লবণের মতো স্বাদ: কিছু রোগী বলেন যে এই তরলটির স্বাদ কিছুটা লবণের মতো বা ধাতব স্বাদের মতো।
- গ্লুকোজ পরীক্ষা: এই তরলে উচ্চ মাত্রায় গ্লুকোজ থাকে, যা সাধারণ নাকের সর্দিতে থাকে না। চিকিৎসকরা একটি বিশেষ পরীক্ষা (গ্লুকোস্টিক টেস্ট) করে এটি নিশ্চিত করতে পারেন।
- “হ্যালো সাইন” বা “রিং সাইন”: যদি এই তরলটি কোনো টিস্যু বা কাপড়ে পড়ে শুকিয়ে যায়, তবে এটি মাঝখানে একটি হালকা হলদেটে দাগ এবং তার চারপাশে একটি পরিষ্কার “হ্যালো” বা “রিং” তৈরি করে। এটি নিশ্চিতভাবে সিএসএফ নির্দেশ করে না, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
- মাথাব্যথা: মস্তিষ্কের চারপাশের তরল কমে যাওয়ায় মস্তিষ্কের উপর চাপ কমে যায়, যা তীব্র মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে পারে (low pressure headache)।
- মেনিনজাইটিসের লক্ষণ: যদি সিএসএফ লিকের কারণে সংক্রমণ হয়, তবে জ্বর, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, আলোতে সংবেদনশীলতা এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন (মেনিনজাইটিসের লক্ষণ) দেখা দিতে পারে। এটি একটি জরুরি অবস্থা।
কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়?
সিএসএফ রাইনোরিয়া নির্ণয়ের জন্য একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞ বেশ কিছু পরীক্ষা করতে পারেন:
- রোগীর ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা: নাক দিয়ে ঝরা তরল, এর প্রকৃতি এবং কখন এটি বেড়ে যায়, সেই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হয়।
- ল্যাবরেটরি পরীক্ষা:
- বিটা-২ ট্রান্সফেরিন পরীক্ষা (Beta-2 Transferrin Test): এটি সিএসএফ নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। এই প্রোটিনটি শুধুমাত্র সিএসএফ-এ পাওয়া যায়, অন্য কোনো শরীরিক তরলে থাকে না।
- গ্লুকোজ পরীক্ষা: নাক দিয়ে ঝরা তরলে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
- ইমেজিং পরীক্ষা:
- হাই-রেজোলিউশন সিটি স্ক্যান (High-Resolution CT Scan): মাথার খুলির হাড়ের খুব ছোট ফাটল বা ছিদ্র শনাক্ত করার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- সিএসএফ লিক স্টাডি (CSF Leak Study): এটি একটি বিশেষ পরীক্ষা যেখানে সিএসএফ-এ একটি রঞ্জক পদার্থ (tracer) ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং তারপর সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করা হয়। এর মাধ্যমে লিকের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করা যায়।
- এমআরআই (MRI): মস্তিষ্কের কোনো অস্বাভাবিকতা বা টিউমার আছে কিনা তা দেখতে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
সিএসএফ রাইনোরিয়ার চিকিৎসা লিকের কারণ, অবস্থান এবং রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো লিক বন্ধ করা এবং মেনিনজাইটিস প্রতিরোধ করা।
- সার্জারি ছাড়া চিকিৎসা (Conservative Management):
- ছোটখাটো আঘাতের কারণে সৃষ্ট কিছু লিক নিজে থেকেই সেরে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীকে কঠোর বিছানায় বিশ্রাম নিতে, কাশি বা হাঁচি এড়াতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে বলা হয়।
- মস্তিষ্কের চাপ কমাতে কিছু ঔষধ দেওয়া হতে পারে।
- মেনিনজাইটিস প্রতিরোধের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
- লাম্বার ড্রেন (Lumbar Drain) বসিয়ে মেরুদণ্ডের স্পাইনাল ফ্লুইড বের করে মস্তিষ্কের চাপ কমানো হতে পারে, যা লিক বন্ধ হতে সাহায্য করে।
- সার্জিক্যাল চিকিৎসা (Surgical Repair):
- যদি লিক নিজে থেকে বন্ধ না হয়, বা যদি লিকটি বড় হয়, বা যদি মেনিনজাইটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে, তবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
- এন্ডোস্কোপিক রিপেয়ার (Endoscopic Repair): এটি বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। একজন ইএনটি সার্জন নাকের ভেতর দিয়ে এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে লিকের স্থানটি খুঁজে বের করেন এবং শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে নেওয়া টিস্যু (যেমন চর্বি, পেশীর আস্তরণ বা কার্টিলেজ) দিয়ে ছিদ্রটি বন্ধ করে দেন। এটি একটি ন্যূনতম আক্রমণাত্মক পদ্ধতি এবং এর সাফল্যের হার অনেক বেশি।
- ক্র্যানিওটমি (Craniotomy): খুব জটিল বা বড় লিকের ক্ষেত্রে খুলি খুলে মস্তিষ্কের দিক থেকে লিক মেরামত করার প্রয়োজন হতে পারে। এটি সাধারণত নিউরোসার্জনরা করে থাকেন।
কেন দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন?
সিএসএফ রাইনোরিয়াকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। এর প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুতর জটিলতা হলো মেনিনজাইটিস (Meningitis), যা মস্তিষ্কের আবরণের একটি সংক্রমণ। মেনিনজাইটিস প্রাণঘাতী হতে পারে অথবা মস্তিষ্কের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া বারবার সিএসএফ লিকের কারণেও মস্তিষ্কের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
শেষ কথা:
নাক দিয়ে পানি পড়া একটি সাধারণ উপসর্গ, তবে এর আড়ালে থাকতে পারে সিএসএফ রাইনোরিয়ার মতো গুরুতর সমস্যা। যদি আপনার নাক দিয়ে স্বচ্ছ, পানির মতো তরল ক্রমাগত ঝরতে থাকে, বিশেষ করে যদি তা মাথার আঘাতের পর বা মাথা নিচু করলে বেড়ে যায়, তবে এটিকে সাধারণ সর্দি ভেবে অবহেলা করবেন না। দ্রুত একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আপনাকে গুরুতর জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে এবং আপনার জীবন রক্ষা করতে পারে। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতে – সচেতন থাকুন এবং সুরক্ষিত থাকুন।