অনেক সময় আমরা আমাদের নিজেদের বা শিশুদের কানের সামনের দিকে, ঠিক যেখানে কানের কার্টিলেজ মুখের ত্বকের সাথে মেশে, সেখানে একটি অত্যন্ত ছোট ছিদ্র দেখতে পাই। এটি সাধারণত জন্ম থেকেই থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যাই করে না। এই ছোট ছিদ্রটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় প্রিঅরিকুলার সাইনাস (Preauricular Sinus) বা প্রিঅরিকুলার পিট (Preauricular Pit) বলা হয়।
অভিভাবকরা প্রায়শই এই ছিদ্রটি দেখে চিন্তিত হয়ে আমাদের কাছে আসেন। এটি কি কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ? এটি থেকে কি ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হতে পারে? আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমি এই সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রিঅরিকুলার সাইনাস কী এবং কেন হয়?
প্রিঅরিকুলার সাইনাস হলো একটি জন্মগত ত্রুটি। সহজভাবে বললে, এটি ত্বকের নিচে একটি সরু সুড়ঙ্গের মতো পথ (Tract), যার একটি মুখ বাইরের ত্বকে ছিদ্র হিসেবে দেখা যায়। এই সুড়ঙ্গটি কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং এর শেষ প্রান্তটি ত্বকের নিচে বন্ধ থলিতে শেষ হয়।
এটি কেন হয় তা বুঝতে হলে আমাদের ভ্রূণ অবস্থায় কান তৈরির প্রক্রিয়াটি জানতে হবে। যখন একটি শিশু মায়ের গর্ভে থাকে, তখন তার বহিঃকর্ণ বা পিনা (Pinna) ছয়টি ছোট ছোট টিস্যুর পিন্ড (Hillocks of His) একত্রিত হয়ে তৈরি হয়। যদি এই পিন্ডগুলো একত্রিত হওয়ার সময় সামান্য অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, তবে সেখানে একটি ছোট গর্ত বা সুড়ঙ্গের মতো পথ তৈরি হতে পারে। এটিই প্রিঅরিকুলার সাইনাস।
এটি বংশগতও হতে পারে, অর্থাৎ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই সমস্যা থাকতে পারে। সাধারণত এটি এক কানে দেখা গেলেও, কিছু ক্ষেত্রে উভয় কানেও থাকতে পারে।

এর লক্ষণগুলো কী কী?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রিঅরিকুলার সাইনাস কোনো লক্ষণ ছাড়াই সারাজীবন থেকে যায়। অনেকে হয়তো এটি লক্ষ্যই করেন না। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে:
- কোনো লক্ষণ না থাকা: এটিই সবচেয়ে সাধারণ অবস্থা। শুধু একটি ছোট ছিদ্র ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
- তরল নিঃসরণ: মাঝেমধ্যে ছিদ্রটি থেকে সাদা, পনিরের মতো বা দুর্গন্ধযুক্ত আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। এটি হলো সাইনাসের ভেতরের ত্বকের মৃত কোষ এবং তেল।
- ইনফেকশন বা সংক্রমণ: এটিই প্রিঅরিকুলার সাইনাসের প্রধান জটিলতা। সাইনাসের মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে এর ভেতরে ইনফেকশন হতে পারে।
- ইনফেকশনের লক্ষণসমূহ:
- ছিদ্রের চারপাশে ফুলে যাওয়া।
- তীব্র ব্যথা হওয়া।
- জায়গাটি লাল হয়ে যাওয়া এবং গরম অনুভূত হওয়া।
- ছিদ্র দিয়ে পুঁজ বের হওয়া।
- কিছু ক্ষেত্রে পুঁজ জমে ফোড়া বা অ্যাবসেস (Abscess) তৈরি হওয়া।
- চুলকানি: ছিদ্রের চারপাশে হালকা চুলকানি হতে পারে।
কেন এতে ইনফেকশন হয়?
সাইনাস ট্র্যাক্ট বা সুড়ঙ্গটির শেষে একটি বন্ধ থলি। এর ভেতরে ত্বকের মৃত কোষ, তেল এবং ঘাম জমা হতে থাকে। এই জমে থাকা পদার্থগুলো ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। যখন সাইনাসের মুখ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তখন এই জীবাণুগুলো দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে ইনফেকশন তৈরি করে।
কী করবেন এবং কী করবেন না?
এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক যত্ন নিলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
কী করবেন:
- ছিদ্রের চারপাশ পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন।
- যদি ইনফেকশনের কোনো লক্ষণ (ব্যথা, ফোলা, লাল হওয়া) দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
কী করবেন না:
- কখনোই ছিদ্রটি চাপাচাপি বা খোঁটাখুঁটি করবেন না। অনেকে ভেতর থেকে ময়লা বের করার জন্য এটি চিপে দেন, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে ইনফেকশন ত্বকের আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং ফোড়া তৈরি হতে পারে।
- ছিদ্রের ভেতরে সেফটিপিন, কাঠি বা অন্য কিছু প্রবেশ করানোর চেষ্টা করবেন না।
- ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করবেন না।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
সাধারণত একজন চিকিৎসক এটি দেখেই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। এর জন্য বিশেষ কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।
এর চিকিৎসা নির্ভর করে সাইনাসটির অবস্থার উপর:
১. যদি কোনো লক্ষণ না থাকে: যদি সাইনাসে কোনো ব্যথা, ফোলা বা নিঃসরণ না থাকে, তবে এর জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। এটিকে তার নিজের মতো থাকতে দেওয়াই শ্রেয়।
২. যদি ইনফেকশন হয় (Acute Infection): যদি সাইনাসে ইনফেকশন হয়, তখন চিকিৎসা হলো:
- অ্যান্টিবায়োটিক: ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে।
- ব্যথানাশক: ব্যথা কমানোর জন্য ঔষধ দেওয়া হয়।
- গরম সেঁক: হালকা গরম সেঁক দিলে ব্যথা ও ফোলা কমতে পারে।
- পুঁজ বের করা (Incision & Drainage): যদি পুঁজ জমে ফোড়া তৈরি হয়ে যায়, তবে চিকিৎসক একটি ছোট অপারেশনের মাধ্যমে জায়গাটি কেটে পুঁজ বের করে দেন। মনে রাখতে হবে, এটি শুধু তাৎক্ষণিক আরামের জন্য। এটি সাইনাসের স্থায়ী সমাধান নয়।
৩. স্থায়ী সমাধান (Definitive Treatment): যাদের বারবার ইনফেকশন হয় বা ক্রমাগত তরল নিঃসরণের কারণে দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়, তাদের জন্য একমাত্র স্থায়ী সমাধান হলো অস্ত্রোপচার বা সার্জারি।
এই অপারেশনে, ছিদ্র সহ সম্পূর্ণ সাইনাস ট্র্যাক্ট বা সুড়ঙ্গটিকে কেটে বের করে আনা হয়। একে “এক্সিশন অফ প্রিঅরিকুলার সাইনাস ট্র্যাক্ট” (Excision of Preauricular Sinus Tract) বলা হয়। সম্পূর্ণ ট্র্যাক্টটি সফলভাবে অপসারণ করা গেলে এই সমস্যা পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না। ইনফেকশন থাকা অবস্থায় এই অপারেশন করা হয় না; প্রথমে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ইনফেকশন সারিয়ে, কয়েক সপ্তাহ পর অপারেশনের দিন নির্ধারণ করা হয়।
এর সাথে কি কানের অন্য কোনো সমস্যা জড়িত?
এটি একটি সাধারণ উদ্বেগ। তবে আনন্দের বিষয় হলো, শুধুমাত্র একটি প্রিঅরিকুলার সাইনাস থাকা মানেই কানের ভেতরের বা শোনার কোনো সমস্যা থাকা নয়। খুব বিরল কিছু জেনেটিক সিনড্রোমের (যেমন, BOR Syndrome) ক্ষেত্রে প্রিঅরিকুলার সাইনাসের সাথে কানের গঠনগত ত্রুটি, শ্রবণশক্তি হ্রাস বা কিডনির সমস্যা থাকতে পারে। তবে এমন রোগীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সাধারণ প্রিঅরিকুলার সাইনাস একটি নিরীহ সমস্যা।
শেষ কথা
কানের পাশের ছোট ছিদ্র বা প্রিঅরিকুলার সাইনাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি নিরীহ জন্মগত অবস্থা। এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে এতে যদি বারবার ইনফেকশন হয় বা এটি আপনার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে অবশ্যই একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই সমস্যা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।